হোমিওপ্যাথি কি বিজ্ঞান?

হোমিওপ্যাথি কি বিজ্ঞান?


শ্রিয়ংকর আচার্য


ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার পথিকৃৎ ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার স্মরণে এই লেখা। তিনি নিজে এলোপ্যাথিতে সফল হয়েও তা ছেড়ে সারাজীবন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেছেন।

হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞান কিনা তাই নিয়ে সেদিন বিতর্ক চলছিল। কিন্তু এখানে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। বিজ্ঞানের যে সংজ্ঞা আমরা মেনে নিয়েছি সেই অনুসারে হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞান নয়। এখানে অন্য ঘরাণার চিকিৎসকদের কায়েমী স্বার্থ, অপপ্রচার ও বিরোধিতার প্রশ্ন বিবেচ্য নয়, কেবল তত্ত্ব ও যুক্তি বিবেচ্য।

ঠিক আছে, হোমিওপ্যাথি না হয় বিজ্ঞান নয়, তাই বলে কি এটা মিথ্যা? পরিত্যাজ্য? বিজ্ঞান না হলে সব মিথ্যা হয়ে যায়?

শিল্পকর্ম, যা ভাবকে রসে রূপান্তরিত করে, বিজ্ঞান কি পারবে সেই ভাব আর রসের কারণ দেখাতে? শিল্পে রস সৃষ্টি হল কিনা, অর্থাৎ তা রসোত্তীর্ণ হল কিনা তা কি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা যায়? রসিক ও অরসিকের মধ্যে পার্থক্য কি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্ণয় করা যায়? অহেতুক স্নেহ, প্রেম, ভক্তি - তা কি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সৃষ্টি করা যায়? অনেকে বলবেন, এগুলো জড় জগতের বিষয় নয় তাই বিজ্ঞান কি করে ব্যাখ্যা করবে? উত্তরে অনেকে বলবেন, কেন? তার জন্য তো জীববিজ্ঞান রয়েছে। জীববিজ্ঞান পারবে। কিন্তু জীববিজ্ঞান বলে কি আদৌ কিছু হয়? বিজ্ঞান তো জীবনকেই সংজ্ঞায়িত করতে পারে নি, তাহলে জীববিজ্ঞান আসে কি করে? আসলে জীববিজ্ঞান হল জীবদেহে জড়বিজ্ঞানের চর্চা। তাই নয় কি?

তাহলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কি হবে? সেও তো জীবদেহে জড়বিজ্ঞান। এখন প্রশ্ন, এলোপ্যাথি বিজ্ঞান হল আর হোমিওপ্যাথি হল না কেন? এককথায় বলতে গেলে এলোপ্যাথিতে জীবদেহে জড়বিজ্ঞানের প্রয়োগ বোঝা যায় বিজ্ঞাননির্দিষ্ট methodologyর সাপেক্ষে। বিজ্ঞান হতে গেলে methodology মানতে হয়। হোমিওপ্যাথিতে সেই মান্যতার অভাব, তাই হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞানসম্মত নয়।

বৈজ্ঞানিক methodologyতে কোন তত্ত্বকে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষাগারে প্রমাণ করতে হয়। এখানে পরিমাপযোগ্যতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানের সাহায্যে কতদূর পর্যন্ত পরিমাপ করতে পারি? সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর দিকে অগ্রসর হলে পরিমাপে অনিশ্চয়তা আসে, বিজ্ঞানসম্মত অনিশ্চয়তা। পরিমাপ যে সূক্ষ্মতায় পৌঁছতেই পারে না সে জগত তো বিজ্ঞানের বর্তমান এক্তিয়ারের বাইরে। কিন্তু সত্য তো সেখানেই রয়েছে, কেন না সূক্ষ্মই তো স্থূলের কারণ। মহাকারণেই মহা সত্য নিহিত যেখানে বর্তমানের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতি পৌঁছতে পারছে না। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি স্থূল, পরিমেয় বস্তু সূক্ষ্ম - তাহলে জানা যাবে কি করে? তাহলে beyond science যেতে হবে, beyond reasoning. সেখানেই super-conscious perceptionএর খেলা যা একমাত্র ঋষির হতে পারে নিদিধ্যাসনের মাধ্যমে। হোমিওপ্যাথি যদি ঋষি উদ্ভাবিত hypothesisএর মাধ্যমে রোগের কারণ খুঁজে পায় এবং তার নিরসন করে তাহলে রোগ সারতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া না গেলেও তার কার্যকারিতার নিরীখে তাকে গ্ৰহণ করা যেতে পারে। যদি কারুর মনে হয় হোমিওপ্যাথিতে কাজ হয় না সে গ্ৰহণ করবে না, কিন্তু দয়া করে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে বরখাস্ত করবেন না। বিজ্ঞান যতদিন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সূক্ষ্মতায় না পৌঁছচ্ছে ততদিন হোমিওপ্যাথিকে বিজ্ঞানের সঙ্কীর্ণ ঘরে ঢোকানো যাবে না। তাতে কিছু যায় আসে না, হোমিওপ্যাথি যদি সত্য হয়, সেই সত্যতার গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না।

#শ্রিয়ংকর আচার্য