বিজ্ঞান: খায়, না মাথায় দেয়!

বিজ্ঞান: খায়, না মাথায় দেয়!

  • শ্রিয়ংকর আচার্য

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ওজনদার, টেঁকসই, intellectual-প্রিয় শব্দ হল বিজ্ঞান৷ অমুক ism সর্বশক্তিমান, কারণ তাহা বিজ্ঞান৷ বিজ্ঞান মানেই সর্বশক্তিমান৷ একবার কোনভাবে বিজ্ঞানের শংসাপত্র (certificate) জোগাড় করতে পারলেই কেল্লা ফতে৷ সে কুলীনের মধ্যে কুলীন বলে গণ্য হবে৷ সেইজন্য অনেক বিষয়ের শেষে একটা science (যেমন political science, social science) জুড়ে দিয়ে তাকে জাতে তোলা হয়৷ বিজ্ঞানের প্রতি এতটাই ভক্তি ও বিশ্বাস যে কলাবিদ্যাকেও আমরা কলাবিজ্ঞান বানিয়ে দিয়েছি৷

কোনো বিষয়কে 'বিজ্ঞান' খেতাব দিলে তার পিছনে একটা যুক্তি দেখানো হয়৷ যুক্তিটা এই যে, এইসব বিষয় নির্মিত হয়েছে যুক্তি-বিচার-বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে৷ এগুলো কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা উপলব্ধি নয়৷ তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে সোজা কথায়, যুক্তি নির্ভর বিষয়ই বিজ্ঞান৷ কিন্তু এখানে একটা সমস্যা হল, যে সব বিষয়কে যুক্তি বা প্রমাণ নির্ভর বলে ধরে নিচ্ছি সেগুলো কতটা যুক্তি নির্ভর? সেখানে কী ধরণের প্রমাণ ব্যবহৃত হয়? তাহলে প্রথমে তথাকথিত বিজ্ঞান অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কথাই ধরা যাক।

প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে কোনো একটি প্রাকৃতিক তন্ত্র (system ) বা ব্যবস্থার জন্য একটা তত্ত্ব বা মডেল খাড়া করা হয়, তারপর তাই দিয়ে পরীক্ষালব্ধ ফলগুলোকে ব্যাখ্যা করা হয় কিংবা কোন নির্দিষ্ট পরীক্ষায় কি ফলাফল হতে পারে তার সঠিক ভবিষ্যদ্বানী করা হয়। তাছাড়া পরীক্ষাগারে প্রাপ্ত ফলাফল যে মডেলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ তা বারবার পরীক্ষা করে সকলের কাছে প্রমান করা হয়। কিন্তু তা তো humanities বা social scienceএ হয় না৷ প্রমাণ করার মতো পরীক্ষা ব্যবস্থা কোথায়? যে সব পরীক্ষা হয় তাতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির রীতিনীতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায় না৷ সব সময়ই ব্যতিক্রম থেকে যায়, তাই একই সঙ্গে একই বিষয়ে অনেক মডেল উঠে আসে৷ তাই এগুলোকে 'বিজ্ঞান' না বলে 'চর্চা' বা study বলা যেতে পারে৷

'বিজ্ঞান' শব্দটি মূলতঃ জড়বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য৷ কেন না সব বিজ্ঞানের মধ্যে জড়বিজ্ঞানেই সবচেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক যুক্তি বা পদ্ধতির প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে৷ এই যুক্তি প্রয়োগের জন্য একটি গাণিতিক মডেল উদ্ভাবন করা হয় তারপর তা ব্যবহার করা হয় তা হলে দেখা যাক বৈজ্ঞানিক বা গাণিতিক মডেল কিভাবে তৈরী হয় এবং কিভাবে তাকে পরীক্ষালব্ধ ফলের সাপেক্ষে যাচাই করা হয়

জড়বিজ্ঞানে প্রথমে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রাকৃতিক বিষয়গুলির সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (interaction) কে পর্যবেক্ষণ (observation)করা হয়, তাকে মেপে যে তথ্য পাওয়া যায় তা নথিবদ্ধ করা হয় যাতে কোন ভুল না থাকে সেইজন্য বারবার পরীক্ষা ও পরিমাপ করা হয় সেই ইন্দ্রিয়-বিষয় ক্রিয়ালব্ধ তথ্য কে বিশ্লেষণ করেই গাণিতিক মডেল বানানো হয় এবং ওই জাতীয় অন্যান্য পরীক্ষার সাপেক্ষে তা যাচাই করা হয়৷ যদি যাচাই করে কোন ভুল না পাওয়া যায় তবেই তা তত্ত্বের মর্যাদা পায় গাছ থেকে একটা আপেল নিজে নিজেই মাটিতে পড়ল, আকাশে উড়ে গেল না, গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে বাধ্য ছেলের মতো ঘুরেই চলেছে, এক মুহূর্তও থামছে না—এই জাতীয় বেশ কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় পর্যবেক্ষণ করে নিউটনের একাগ্র মনে একটি মডেল জন্ম নিল, তা থেকে একটি প্রাকৃতিক সত্য উন্মোচিত হল৷ এই উন্মোচন বা discover (আবরণ উন্মোচন) কিভাবে হয় তা আমরা জানি না৷ তবে তীব্র একাগ্রতা, স্বজ্ঞা ও পূর্বলব্ধ জ্ঞান এবিষয়ে মুখ্য ভূমিকা নেয়৷ এই উন্মোচিত প্রাকৃতিক সত্যের রূপ বা প্রকাশটা কিরকম?—এটা এমন গাণিতিক সূত্র (model) যা সমজাতীয় ইন্দ্রিয়োপলব্ধ তথ্যগুলিকে ব্যাখ্যা করতে পারে৷ এইসব মডেলের প্রারম্ভিক রূপটার মধ্যে কোন যুক্তি পাওয়া যায় না, তা বিজ্ঞানীর মনের নিভৃত প্রদেশে উপলব্ধ৷ তাই নিয়ে কোন প্রশ্ন চলে না। এগুলো স্বতঃসিদ্ধ বা basic postulatএর আকারে লেখা হয় এবং এর উপর নির্ভর করে পরবর্তী যৌক্তিক ইমারৎ(logical structure) বানানো হয় যা নিয়ে গাণিতিক যুক্তিসহকারে অগ্রসর হলে ওই বিষয় সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায় বা অনেকক্ষেত্রে পরে কী ঘটবে তা বলে দেওয়া (prediction) যায়৷সনাতনী বলবিদ্যা (classical mechanics), কোয়ান্টাম বলবিদ্যা(quantum mechanics) কিংবা তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব (electromagnetic theory) সবই একগুচ্ছ basic postulateএর উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই মডেল যদি কোন ঘটনা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বিজ্ঞানীর কপালে ভাঁজ পড়ে, 'তাই তো, এতগুলো ক্ষেত্রে সফল হল, এক্ষেত্রে কেন হল না?' তখন দরকার হয় পরিমার্জনের, পরিবর্তনের৷ নিউটন যে গতিসূত্র দিলেন তা উচ্চ বেগসম্পন্ন বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হল না৷ তখন পরিমার্জিত হল আইনষ্টাইনৈর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের দ্বারা৷

এক এক জাতীয় প্রাকৃতিক ঘটনা বা ক্রিয়াকলাপের জন্য এক একটি মডেল প্রস্তুত করা হয়েছে৷ যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে (macroscopic world) আমরা রয়েছি, প্রতিনিয়ত প্রকৃতি-ইন্দ্রিয় সংযোগজনিত ঘটনাবলি বুঝতে চাইছি, সেই জগতে ধরা যাক দু রকম ক্রিয়াকলাপ দেখা গেল—মহাকর্ষীয় (gravitational) আর তড়িচ্চৌম্বকীয় (electromagnetic)৷ একই মডেল এই দুই জাতীয় ঘটনাবলিকে ব্যাখ্যা করতে পারল না, তাই তৈরী হল দুটি মডেল৷ এরপরে দেখা গেল পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে যে ঘটনাগুলো ঘটছে তার জন্য আবার আলাদা মডেল দরকার, আগের দুটো দিয়ে কাজে হচ্ছে না৷ আবার দেখা যায় একই প্রাকৃতিক বিষয়ে মডেলের পরিবর্তন বা পরিমার্জনের প্রয়োজন হয় তাকে বিস্তৃততর ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য৷ যেমন নিউটনের মহাকর্ষীয় মডেল পরিমার্জিত হল আইনষ্টাইনের স্থান-কাল জ্যামিতি তত্ত্ব দ্বারা৷ কেবল পরিমার্জন নয় মডেলের একেবারে আমূল পরিবর্তনও হতে পারে যেমন স্থূল জগতের গতিবিদ্যার (classical mechanics) মডেল কেবল পরিমার্জিত নয়, আমূল বদলে গেল সূক্ষ্ণ জগতের গতিবিদ্যার ক্ষেত্রে (quantum mechanics)৷ সেই সূক্ষ্ণজগতের গতিবিদ্যার মডেল পরবর্তী কালে আরও বিস্তৃত হল, আরও নূতন রূপ নিল৷

তাহলে দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানের মডেলগুলো নির্দিষ্ট সীমারেখা সাপেক্ষে বা শর্তসাপেক্ষে কিছু প্রাকৃতিক সত্যের সন্ধান দিতে পারে৷ জড় জগতে যদিও কিছুটা পারে জীবজগতে সেটা খুবই কম, কেন না বিজ্ঞান জীবনকে এখনও সংজ্ঞায়িত করতে পারে নি৷ জীববিজ্ঞান তাই মূলতঃ জীবদেহে জড় বিজ্ঞান৷ নূতন নূতন মডেল উদ্ভাবিত হয় প্রয়োগক্ষেত্রের সীমারেখাটাকে বাড়ানোর জন্য৷ সেই সীমারেখা বৃদ্ধির হার একশো দুশো বছর আগে যা ছিল এখন সে তুলনায় খুবই কম৷ কেন না, কেবল তাত্ত্বিক মডেল দিলেই কাজ শেষ হয় না তাকে পরীক্ষাগারে প্রমাণ করতে হয়, প্রমাণ না করা পর্যন্ত সে মডেল গ্রহণযোগ্য নয়৷ পরীক্ষাগত প্রমাণের ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে বাধাটা এই যে, যাকে পরীক্ষা করছি তা সূক্ষ্ণতা বা ব্যাপকতার নিরীখে চাক্ষুষ জগত থেকে যত দূরে যাবে পরীক্ষাগত প্রমাণ করা ততই শক্ত হবে৷ আজ যে সূক্ষ্ণতা পর্যন্ত পরীক্ষাপদ্ধতি যেতে পারে সেটাই তো শেষ সূক্ষ্ণতা নয়৷ কাল তার চেয়েও সূক্ষ্ণতর জগতে যেতে হবে, কেন না প্রাকৃতিক সত্য নির্ণয়ে সূক্ষ্ণতার শেষ নেই সত্য নির্ণয়ে সূক্ষ্ণতার ভূমিকা তখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে৷ বৈজ্ঞানিক মডেল বা পরীক্ষা কি শেষ সূক্ষ্ণতায় পৌঁছতে পারবে? নাকি সে জগত বিজ্ঞানে অধরা থেকে যাবে? একই প্রশ্ন ব্যাপকতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ ছোটকে জানার ক্ষেত্রে পরীক্ষাব্যবস্থা যেমন বাধা, তেমনি বড়কে জানার ক্ষেত্রেও৷ বিজ্ঞান থেমে থাকবে না ঠিকই৷ পরীক্ষাব্যবস্থার উন্নতিসাধন করে সে মন্থরগতিতে এগোতে থাকবে৷ সে চলার শেষ নেই, পরম সত্য হয়তো ধরা যাবে না তবে তার দিকনির্দেশ পাওয়া যেতে পারে৷