শিক্ষা: খায়, না মাথায় দেয়?

শিক্ষা: খায়, না মাথায় দেয়?

শ্রিয়ঙ্কর আচার্য

কয়েকটি তথ্যে চোখ রাখি৷

গত পাঁচ বছরে IITর 23 জন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে৷ এই সেদিন, ডিসেম্বর 2019, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্প্যুটার সায়েন্সের এক ছাত্র একই কাজ করল৷ এরা শিক্ষা বা মেধার দিক থেকে অতি উচ্চ মানের৷ পরিসংখ্যান বলছে, বিগত 2018তে পশ্চিমবঙ্গে মোট আত্মহত্যার সংখ্যা 13255. ভারতের মধ্যে তৃতীয় স্থানাধিকারী৷

Derek Humphrey রচিত ‘Final Exit’ প্রকাশিত হয় 1991 সালে৷ Newyork Timesএর বেস্ট সেলার লিস্টে ছিল৷ এটা কোন উপন্যাস নয়, কি করে আত্মহত্যা করতে হয় তারই অনেক আধুনিক যন্ত্রণাহীন সহজ উপায় এতে বলা আছে৷ লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রী হয়েছে, আত্মহত্যার কাজেও লেগেছে৷ ছাত্র, যুবা, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ—সকলেই ব্যবহার করেছে৷ তেমনি জাপানে ‘the complete manual of suicide’ 1993 সালে প্রকাশিত হয়, লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রীত ও ব্যবহৃত হয়৷ ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্কুল পড়ুয়াও আছে৷ তেমনি ফ্রান্স বা অন্যান্য শিক্ষিত ও উন্নত দেশেও কমবেশি একই ছবি৷

বিশ্বে প্রায় 80,000 মানুষ প্রতিদিন আত্মহত্যায় মারা যায়৷ প্রতি 40 সেকেন্ডে একজন৷ 15-24 বছর বয়সীদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে আত্মহত্যাই দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ৷

আমেরিকায় আঠারো বা তার বেশী বয়সীদের 20-25% মানুষ মানসিক অবসাদের (depression) শিকার৷ আর মানসিক অবসাদ থেকেই ঘটে আত্মহত্যা৷ বিশ্বে আজ মানসিক অবসাদকেই ( depression) সবচেয়ে বড় অসুখ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে৷

এ তো শিক্ষিত সুসভ্য দেশের শিক্ষিত লোকেদেরই অসুখ৷ শিক্ষা পারে নি এ অসুখকে দূরে সরিয়ে রাখতে৷ শিক্ষা পারে নি অবসাদের জায়গায় অানন্দ নিয়ে আসতে৷ শিক্ষায় নিশ্চয়ই কোন গলদ আছে৷ তাহলে ‘শিক্ষা’র নামে যা চলছে তা কি প্রকৃত শিক্ষা? কাকে বলে প্রকৃত শিক্ষা? কে দেবে শিক্ষার একটি সম্পূর্ণ একীভূত (complete and unified) সংজ্ঞা?

তার আগে আমরা দেখে নিই ‘তোতা কাহিনী’তে রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত শিক্ষার কী রূপ দেখিয়েছেন৷

“শিক্ষা যে কী ভয়ংকর তেজে চলিতেছে, রাজার ইচ্ছা হইল স্বয়ং দেখিবেন। একদিন তাই পাত্র মিত্র অমাত্য লইয়া শিক্ষাশালায় তিনি স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত।

দেউড়ির কাছে অমনি বাজিল শাঁখ ঘণ্টা ঢাক ঢোল কাড়া নাকাড়া তুরী ভেরি দামামা কাঁসি বাঁশি কাঁসর খোল করতাল মৃদঙ্গ জগঝম্প। পণ্ডিতেরা গলা ছাড়িয়া, টিকি নাড়িয়া, মন্ত্রপাঠে লাগিলেন। মিস্ত্রি মজুর স্যাকরা লিপিকর তদারকনবিশ আর মামাতো পিসতুতো খুড়তুতো এবং মাসতুতো ভাই জয়ধ্বনি তুলিল।

ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, কাণ্ডটা দেখিতেছেন!’

মহারাজ বলিলেন, ‘আশ্চর্য। শব্দ কম নয়।’

ভাগিনা বলিল, ‘শুধু শব্দ নয়, পিছনে অর্থও কম নাই।’

রাজা খুশি হইয়া দেউড়ি পার হইয়া যেই হাতিতে উঠিবেন এমন সময়, নিন্দুক ছিল ঝোপের মধ্যে গা ঢাকা দিয়া, সে বলিয়া উঠিল, ‘মহারাজ, পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি।’

রাজার চমক লাগিল; বলিলেন, ‘ঐ যা! মনে তো ছিল না। পাখিটাকে দেখা হয় নাই।’

ফিরিয়া আসিয়া পণ্ডিতকে বলিলেন, ‘পাখিকে তোমরা কেমন শেখাও তার কায়দাটা দেখা চাই।’

দেখা হইল। দেখিয়া বড়ো খুশি। কায়দাটা পাখিটার চেয়ে এত বেশি বড়ো যে, পাখিটাকে দেখাই যায় না; মনে হয়, তাকে না দেখিলেও চলে। রাজা বুঝিলেন, আয়োজনের ত্রুটি নাই। খাঁচায় দানা নাই, পানি নাই; কেবল রাশি রাশি পুঁথি হইতে রাশি রাশি পাতা ছিঁড়িয়া কলমের ডগা দিয়া পাখির মুখের মধ্যে ঠাসা হইতেছে। গান তো বন্ধই, চীৎকার করিবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা। দেখিলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়।”

বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই৷ বলা বাহুল্য, এই ব্যবস্থায় পাখিটি মারা গেল৷

তাহলে পাখিটিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে না দিয়ে তার জীবন কিভাবে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারি? সেটাই তো শিক্ষা৷ স্বামী বিবেকানন্দ দিচ্ছেন শিক্ষার সেই কাঙ্ক্ষিত পরিপূর্ণ একীভূত সংজ্ঞা:

“Education is the manifestation of perfection already im man.”

দেখা যাক “perfection” বলতে তিনি কী বলতে চেয়েছেন৷ আমরা আমাদের জ্ঞানে কর্মে ত্রুটিহীন হতে চাই শিক্ষার মাধ্যমে, যে ত্রুটিহীনতা আমাদের মধ্যেই রয়েছে অর্থাৎ আমাদের সহজাত, কিন্তু অজ্ঞান-সংস্কার দ্বারা আবৃত৷ শিক্ষা সেই আবরণ সরানোর কাজটি করে৷ আবরণ সরে গেলে আমরা জ্ঞানে কর্মে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হই৷

এই perfectionএর দুটি দিক: বাইরের দিক (external) এবং ভেতরের দিক(internal). আমরা যদি বাইরের দিক থেকে দেখি তাহলে বলব শিক্ষার মাধ্যমে আমরা দক্ষ পেশাদার (skilled professional) হই৷ ভাল বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, চিকিৎসক, অর্থনীতিবিদ—ইত্যাদি হয়ে ওঠাটা perfectionএর বহিরঙ্গ৷ এগুলির চর্চা ও প্রয়োগ বাইরের জগতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে৷ কিন্তু একজন দক্ষ পেশাদার যে লোভী দুর্নীতিগ্রস্ত বা মানসিক অবসাদগ্রস্ত হবে না এমন আশ্বাস বহিরঙ্গের perfection দেয় না৷ তাই শিক্ষিতদের মধ্যেও এত দুর্নীতি, লোভ, নিরানন্দময় অবসাদগ্রস্ততা৷ তাহলে শুধু external skill বাড়িয়ে perfect হওয়াটাই শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না৷ তাই বহির্জগতের perfection এর সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্জগতের perfectionএর দিকে মন দিতে হবে৷

কী সেই internal perfection? এই internal perfectionকে স্বামিজী বলেছেন divinity, যা মানুষের সমস্ত সদ্গুণের (values) সমষ্টি বা চরিত্র এবং যা মানুষের সহজাত৷ এই সহজাত সদ্গুণগুলি আমাদের অসৎ কর্ম দ্বারা অর্জিত অসদ্গুণের সংস্কারের আবরণে আবৃত৷ সেই অসদ্গুণের সংস্কারের আবরণ সরিয়ে সদ্গুণগুলোকে বিকশিত করলেই আমরা internal perfection অর্জন করব৷ তার উপায় আধ্যাত্মিক অনুশীলন, স্বামিজী যাকে বলেছেন ধর্ম(religion). তাই বলছেন, religion is the manifestation of divinity already in man.’

আধ্যাত্মিক অনুশীলন আসলে অন্তর্জগতের অবলোকন যা থেকে আসবে আত্মজ্ঞান (Self realisation)৷ আত্মজ্ঞানী সর্বদাই সদ্গুণে প্রতিষ্ঠিত৷ অন্তর্বিজ্ঞান ও বহির্বিজ্ঞান, এই দুইয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে প্রকৃত শিক্ষা৷

ভারতবর্ষে হাজার হাজার বছর ধরে এই পরিপূর্ণ শিক্ষাই প্রচলিত ছিল৷ মুণ্ডক উপনিষদ বলছে, “দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে, পরা চৈব অপরা চ…”৷ পরাবিদ্যা চাই internal perfectionএর জন্য, আর অপরাবিদ্যা চাই external(ব্যবহারিক জগতের) perfectionএর জন্য৷ বর্তমান শিক্ষায় কেবল অপরাবিদ্যা, তাই এই বিপর্যয়৷ আবার প্রাচীন ভারতকে অনুশরণ করে পরাবিদ্যার প্রচলন করতে হবে আধুনিক বিজ্ঞানকে সঙ্গী করে৷ নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়৷

দুই perfetionএর মিলনেই প্রকৃত শিক্ষা৷

লেখক: শ্রিয়ংকর আচার্য