আবৃত্তিঃ খায়, না মাথায় দেয়?

আবৃত্তিঃ খায়, না মাথায় দেয়?

শ্রিয়ংকর আচার্য

শিল্প বা শিল্পমাধ্যমের কাজ ভাবকে রসে রূপান্তরিত করা৷ আবৃত্তি যদি শিল্প হয় তাহলে আবৃত্তির কাজও তাই৷ ভাবটা কার? — অবশ্যই আবৃত্তিকারের৷ কিভাবে পাওয়া গেল? — কবিতা থেকে৷ কবিতা যেহেতু নিজেই একটা শিল্পমাধ্যম(কথাশিল্প বা সাহিত্য) তাই এখানেও প্রশ্ন ওঠে ভাবটা কার? — অবশ্যই কবির৷ কিভাবে তা রসে রূপান্তরিত হল? — কথা বা শব্দের সমন্বয়ে এক বিশেষ উপস্থাপনাগুণে৷ এই বিশেষ উপস্থাপনাই ভাবকে রসে রূপান্তরিত করে৷ সব শিল্পেই তাই৷ এ কাজে নানারকম উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে৷ উপস্থাপনার উপকরণভেদে কখনো হয় চিত্রশিল্প, কখনো বা সঙ্গীতশিল্প আবার কখনো বা কথাশিল্প৷ এগুলোর সম্মিলিত প্রয়োগে কখনো নাট্যশিল্প, কখনো চলচ্চিত্রশিল্প ইত্যাদি আরও হরেকরকম শিল্প৷ উপকরণ যাই হোক তার কাজ ভাবকে রসে রূপান্তরিত করা৷ উৎপন্ন রস আস্বাদিত হলে আস্বাদকের অন্তরে সেই ভাবের সঞ্চার হয় যা অনির্বচনীয় আনন্দ দেয়৷ তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? কবির মনে যে ভাব ছিল তা কবিতার মাধ্যমে রসে রূপান্তরিত হয়েছে৷ কবিতা পড়ে আবৃত্তিকার সেই রস আস্বাদন করে কবির ভাবটি লাভ করেছেন৷ এখন তাঁর কাজ সেই ভাবটিকে কন্ঠশৈলীর মাধ্যমে রসে রূপান্তরিত করা যা শুনে শ্রোতার রসাস্বাদন হবে, এবং শ্রোতাও সেই ভাবের অধিকারী হবে৷ শিল্পী তখনই ভাবকে রসে রূপান্তরিত করতে বাধ্য হন যখন ভাবের আতিশয্যে তাঁর হৃদয়ের এ-কূল ও-কূল দু’কূল ভেসে যায়৷ উপস্থাপনার মাধ্যমে রস সৃষ্টি না করে তিনি থাকতে পারেন না৷ তাই এই প্রক্রিয়ায় প্রথম শর্ত হল—আবৃত্তিকারকে রসিক হতে হবে যাতে তিনি কবিতার রসাস্বাদনে সক্ষম হন ও কবির ভাবটি তীব্রভাবে লাভ করতে পারেন৷ এই শর্তপূরণ না হলে পরের ধাপে গিয়ে কোন লাভ হবে না৷

পরের ধাপে থাকছে কন্ঠনির্মাণ, উচ্চারণ, স্বরক্ষেপন ইত্যাদি উপকরণগত দিক৷ এগুলোর প্রয়োজন উপস্থাপনার জন্য, কেন না উপযুক্ত উপস্থাপনার মাধ্যমে ভাবটিকে রসে রূপান্তরিত করতে হবে৷ যখন কবিতা ছিল তখন ছিল লিপি মাধ্যম, এখন হল বাচিক মাধ্যম৷ আবৃত্তিকারের অন্তরে কবিতার ভাবই যদি না থাকে তাহলে উপস্থাপনার সব আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যায়৷ আবার যদি ভাব থাকেও প্রশিক্ষণের দোষে বিকৃত উপস্থাপনায় তা অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়৷ প্রশিক্ষক যদি সব কিছু বেঁধে দেন তাহলে ভাবের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ থাকে না, তা কৃত্রিম বা যান্ত্রিক হয়ে যায়, তাতে রস সৃষ্টি হয় না৷ এই বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারটা খুব চোখে পড়ে —এই শব্দে গলাটা নামাতে হবে, ঐ শব্দে গলাটা তুলতে হবে, এই জায়গায় গলাটা হাল্কা করে ভাসিয়ে দিতে হবে, এই জায়গায় টেনে রাখতে হবে, ওই জায়গায় একটু দাঁড়াতে হবে … ইত্যাদি৷ ওই ‘লালবাতি’র জায়গাটা এমন ভাবে করতে হবে যেন একটা ভয়াবহ হাহাকার তৈরী হয়৷ বেশ, তাই না হয় হ’ল, কিন্তু ওই আলাদা এক টুকরো হাহাকার কবিতার সমগ্র রূপের সঙ্গে মিশল না, খাপছাড়া হয়ে থেকে গেল৷ সে একটা দ্বীপের মতো আপন স্বাতন্ত্র্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷

এই ভাবে সমগ্র কবিতা জুড়ে অনেক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের সৃষ্টি হল, এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ৷ আসলে যাকে দেখার সে হল রসাস্বাদন থেকে প্রাপ্ত ভাব৷ সে হল সমগ্র কবিতার ব্যঞ্জণার্থ (শব্দার্থ নয়) যা শ্রোতা আস্বাদন করে আনন্দ পাবে৷ আবৃত্তিকার যদি সবসময় অংশগুলোতে মন দেন তাহলে তিনি ভাবের সঙ্গে একাত্ম হবেন কি করে, স্বতঃস্ফূর্ত হবেন কি করে? ভাবের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ না হলে তাতে প্রাণ থাকে না, রসও সৃষ্টি হয় না৷ একটা নিখুঁত পুতুলনাচ হয়৷ লোকে এই পুতুলনাচ দেখে ভাবে এটাই বোধ হয় আবৃত্তি৷ খুব জোর হাততালি দেয়৷ ভালো লাগল, অন্তরটা রসাস্বাদনের আনন্দে ভরে গেল বলে হাততালি দেয় না, মহৎ সাংস্কৃতিক কর্ম বলে হাততালি দেয়৷ আবৃত্তিকার বাজারে বিখ্যাত হলে আরও বেশি হাততালি দেয়৷

আসলে কবিতাকে এভাবে ব্যবচ্ছেদ করলে তার মূলভাবটি অর্থাৎ অবয়বের সামগ্রিক সুষমাটি নষ্ট হয়ে যায়৷ হাতটা পুষ্ট হল তো পা’টা অপুষ্ট থেকে গেল, একটি খাপছাড়া অপূর্ণ দেহ তৈরী হয়৷ যখনই অংশবিশেষ স্বতন্ত্র মনোযোগ পেল তখনই সামগ্রিক ঐক্যের সুরটা কেটে গেল৷ রসাস্বাদনের আনন্দ তো দূরের কথা সেটা একটা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল৷

আবৃত্তিকার অবাক হয়ে বলবেন, তাহলে শব্দগুলোর কী হবে? শব্দ দিয়েই তো কবিতাটা নির্মিত! মনে রাখতে হবে ব্যঞ্জনার্থ বা রস তৈরী হয় সমগ্র কবিতাটি থেকে, কোন বিশেষ শব্দের শব্দার্থ থেকে নয়৷ তাই আবৃত্তি করার সময় আবৃত্তিকার আদৌ সচেতন হবেন না কোন বিশেষ শব্দকে কেমনভাবে উচ্চারণ করতে হবে তাই নিয়ে৷ এমন বিশেষ সচেতনতা রস সৃষ্টির প্রধান অন্তরায় হয় কেন না আবৃত্তিকার তখন ভাব থেকে বিচ্যুত৷ এটা আবৃত্তিকে যান্ত্রিকতা, কৃত্রিমতাদোষে দুষ্ট করে৷

এর উপর আছে অকারণ একঘেয়ে সুরের আমদানি৷ এটা ঠিক, সুর ছাড়া কথা হয় না৷ আমরা যত সাধারণ কথা বলি না কেন তাতে একটা সুর থাকে৷ সুরটা কথার ভাব পৌঁছে দেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আসে৷ জোর করে কৃত্রিমভাবে আনতে হয় না৷ আবৃত্তির ক্ষেত্রেও কবিতার ভাবানুসারী স্বতঃসফূর্ত সুর আসা উচিত, কিন্তু তা আর আসে কই? তার পরিবর্তে একটা কৃত্রিম একঘেয়ে বিরক্তিকর সুর এসে কবিতার রস সৃষ্টির সহায়ক না হয়ে কবিতাটিকে নীরস করে তোলে৷ এই নীরস বিরক্তিকর সুর ছন্দোবদ্ধ কবিতায় বেশি দেখা যায়৷ সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এই সুরই গুরু থেকে শুরু করে গুরু-শিষ্য পরম্পরা চলতে চলতে আবৃত্তির জগতে পুরোপুরি ঘাঁটি গেড়ে বসে গেছে৷ শ্রোতারাও মেনে নিয়েছে৷ ভাল না লাগা সত্ত্বেও দিব্যি হাততালি দিয়ে দিচ্ছে৷ ভালো ভালো লোক ভালো ভালো কাজ করছে, হাততালি না দিলে লোকে আমাকে কী বলবে?

আর একটা রোগ দেখা দিয়েছে সব শিল্পেই—প্রতিষ্ঠিত, প্রচারিত, বিখ্যাত হবার লোভ৷ আবৃত্তি পারি কিনা সেটা কথা নয়, নেটওয়ার্ক তৈরী করতে হবে৷ তুই আমাকে ডাকবি, আমি তোকে ডাকব এর বাইরে সবাই ব্রাত্য৷ আর সভা অলংকৃত করার জন্য ডাকতে হবে বিখ্যাত লোকেদের, যাদের হাতে ক্ষমতা আছে—রাজনৈতিক ক্ষমতা, মঞ্চ পাওয়ানোর ক্ষমতা, মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষমতা ইত্যাদি৷ অনেক হিসেব নিকেষ করে চলতে হয় দাদা, কবিতায় ডুব দেওয়ার সময় কই? ডুব দিয়েই বা লাভ কি? তার চেয়ে এসব বিজনেসে কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা আছে৷ অর্থ আছে, যশ আছে৷ আসলে এই পাটোয়ারী বুদ্ধি যে মনে থাকে সে মনে রসবোধ থাকতে পারে না, তাই ভাবের এত অভাব৷ একে রোবটিক আবৃত্তিও বলা যেতে পারে৷ নিখুঁত উচ্চারণ, নিখুঁত কন্ঠ কিন্তু ভাবহীন যান্ত্রিক স্বরক্ষেপন যা কবিতার মর্ম থেকে বহুদূরে৷ জনগণ রসগোল্লা, রসমালাই কখনো দেখে নি, খায় নি৷ বাজার ভর্তি কেবল বোঁদেই দেখেছে, তাই খাচ্ছে৷ রসগোল্লার স্বাদ পেলে এগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেবে৷ কিন্তু রসগোল্লার নির্মাতা বাজার ধরতে জানে না, সে রসের নির্মাণেই মজে আছে৷ দুটো কাজ যে একই মনে হয় না৷ চালাক ব্যবসায়ী সত্তা আর শিল্পী সত্তা কখনো এক সঙ্গে থাকতে পারে না৷ এইভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম হেগো গুরুর পেদো শিষ্য তৈরী হচ্ছে৷ এভাবেই আবৃত্তি ক্রমশ শিল্পের বিচারে গুণগত মান হারাচ্ছে, একটা বিরক্তিকর জায়গায় চলে যাচ্ছে৷

লেখকঃ শ্রিয়ংকর আচার্য