সংস্কৃতিঃ খায়, না মাথায় দেয়!

সংস্কৃতিঃ খায়, না মাথায় দেয়!

--শ্রিয়ংকর আচার্য

একটু গান গাইতে পারলে কিংবা পদ্য লিখতে বা বলতে পারলে কিংবা কোন শিল্পকর্ম করলে বলি লোকটার সংস্কৃতি আছে, সাংস্কৃতিক জগতের লোক৷ এগুলোর কোনটা না করলে বা এগুলোর সঙ্গে যুক্ত না থাকলে তার কি সংস্কৃতি নেই? একজন প্রখ্যাত গায়কের মুখ দিয়ে যখন তখন অশ্রাব্য গালিগালাজ বেরোয়; না, পাগলের অকারণ গালিগালাজ নয়, অন্যকে অপমানের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত, তিনি কি সংস্কৃতিমান? আর যিনি শিল্পকর্মের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে, খ্যাতির আলো থেকে বহুদূরে থেকে নীরবে মানুষের সেবা করেন, মানুষকে অহেতুক ভালবাসেন তিনি কি সংস্কৃতিমনস্ক নন? একজন কদর্য চরিত্রের লোক গান গাইতে, কিংবা কবিতা লিখতে কিংবা অভিনয় করতে কিংবা ছবি আঁকতে পারেন বলে তিনি সংস্কৃতিমান? আর একজন শুদ্ধচরিত্র মানুষ এগুলোর সঙ্গে যুক্ত না থাকার জন্য তিনি সংস্কৃতিমান নন? তাহলে 'সংস্কৃতি' বলতে কি বোঝায়?

সম্-কৃ + ক্তি = সংস্কৃতি৷ কর্ম যা সম্যক রূপে করা হয়৷ এই সম্যক কর্ম কে করে? -ব্যক্তিই করে৷ কেন করে? -তার অবচেতনে সঞ্চিত সংস্কার তাকে দিয়ে করায়৷ তার সংস্কার কোত্থেকে এল? -তারই পূর্বকৃত চিন্তা ও কর্ম থেকে৷ সেই চিন্তা বা কর্ম এসেছিল কোত্থেকে? -সেখানেও সেই পূর্ব সংস্কার৷ তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল - সংস্কার থেকে চিন্তা ও কর্ম, আবার চিন্তা ও কর্ম থেকে সংস্কার আবার তা থেকে চিন্তা ও কর্ম....এই চক্র চলছে। তাহলে দেখা যাক সংস্কার কাকে বলে, কিভাবে উৎপন্ন হয়।

আমরা যা কিছু করি, চিন্তা বা কর্ম, সবই আমাদের অবচেতন মনে একটা ছাপ রেখে যায়৷ সেই সঞ্চিত ছাপ অর্থাৎ প্রবণতা পরে অনুকূল পরিবেশ পেলে ঐ জাতীয় চিন্তা বা কর্মে অনুপ্রাণিত করে৷ অবচেতন মনে প্রবনতা বা অনুপ্রেরণাগুলো জমতে থাকে। সেগুলোর যোগফলই হল সংস্কার।

ধরা যাক একটি নিপাট ভালো ছেলে, পরীক্ষায় কখনো টোকাটুকি করে নিবন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বা লোভের বশবর্তী হয়ে বহু মানসিক বাধা অতিক্রম করে সে একদিন পরীক্ষায় টুকলি করল। ভয়ে হাত পা কাঁপছিল, জিভ শুকিয়ে আসছিল, যদি ধরা পড়ে যায়? ভালো ছেলে বলে যে ভাবমূর্তিটা আছে তা তো এক মুহূর্তেই ধুলোয় মিশে যাবে! এইসব দুশ্চিন্তার মধ্যে টুকলি করল, কিন্তু ধরা পড়ল না। যে সব বন্ধুরা এ কাজে তাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল তারা বাহবা দিল। সেও আপন কৃতিত্বে খুশি। দ্বিতীয়বার যখন পরীক্ষা এল তখন সে আবার দ্বন্দ্বে পড়ল। তবে এবারের দ্বন্দ্বটা আগের বারের মতো জোরালো নয়। আগেরবারের টুকলিকর্ম ও তার ফলাফল তার অবচেতন মনে প্রবণতা হয়ে সঞ্চিত ছিল। সেই প্রবণতা তার দ্বন্দ্ব কাটিয়ে দিয়ে দ্বিতীয়বার টুকলি করতে এগিয়ে দিল। এবার আর হাত পা কাঁপল না, অত ভয়ও হল না, ধরাও পড়ল না। এবারের কর্মও তার অবচেতনে টুকলি-প্রবণতা হয়ে সঞ্চিত হল। বারবার টুকলি করতে করতে যে প্রবণতাগুলো অবচেতনে জমলো তার যোগফল থেকে তৈরী হল টুকলি-সংস্কার। চিন্তা থেকেও এভাবে সংস্কার উৎপন্ন হতে পারে। যেমন আধ্যাত্মিক চিন্তা থেকে আধ্যাত্মিক সংস্কার, গণিত চিন্তা থেকে গাণিতিক সংস্কার, ধান্দা চিন্তা থেকে ধান্দা-সংস্কার ইত্যাদি।

পূর্ব সংস্কার থেকেই বর্তমান চিন্তা ও কর্মের অনুপ্রেরণা আসে। সেই অনুপ্রেরণাসঞ্জাত কর্ম দিয়েই আসে সংস্কৃতি। প্রথমতঃ এটা ব্যক্তিগত বিষয়, তবে সমাজের সব ব্যক্তিই যদি একই কর্মে অনুপ্রাণিত হয় তাহলে তা সামাজিক সংস্কার হয়ে যায়। সবাই সন্ধ্যেবেলায় হরিনাম করা একটা সামাজিক সংস্কার হতে পারে, যা আগেকার দিনে ছিল। আবার হরিনাম না করে টিভি সিরিয়াল দেখা - তাও সংস্কার হতে পারে, যা এখন আছে। আগে পাড়ার অলিতে গলিতে সন্ধ্যেবলায় কানে আসত হারমোনিয়মের আওয়াজ, সঙ্গে সুরে বেসুরে সা রে গা মা পা...., এখন শোনা যায় টি ভি'র জগঝম্প আওয়াজ। এভাবেই সংস্কৃতি জন্মায় ও ছড়ায়

যে কোন চিন্তা ও কর্ম অবচেতন মনকে ছেড়ে কথা বলে না। অবচেতনে ছুঁচ হয়ে ঢুকবেই এবং শেষ পর্যন্ত ফাল অর্থাৎ সংস্কৃতি হয়ে বেরোবেই। এমন কি গ্ৰাসাচ্ছাদনের জন্য আমরা যে কর্ম করি সেও সংস্কার তৈরী করে। কেউ পুলিস, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল কেউ বা শিক্ষক। এইসব বিভিন্ন পেশাগত কর্মগুলো থেকে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কার তৈরী হতে পারে। পুলিস হওয়ার আগে একজনের যা সংস্কার ছিল পুলিসের চাকরি অনেকদিন করার পর তাতে বদল আসবেই। সঙ্গগুণে ও চরিত্রবলে সৎ সংস্কারও আসতে পারে আবার সঙ্গদোষে ও চরিত্রের দুর্বলতায় অসৎ সংস্কারও আসতে পারে। তবে তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে একটা পুলিসী সংস্কার তৈরী হবে যা তাঁর আচরণকে প্রভাবিত করবে। অন্য পেশার ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। আবার পেশার বাইরে অবসর সময়ে একজন কী করেন সেটাও তাঁর সংস্কার তৈরী করে। পুলিসের ডিউটি সেরে তিনি কবিতা লিখতে পারেন, গান-বাজনা করতে পারেন, পূজা-জপ-ধ্যানও করতে পারেন। সবই সংস্কারের খাতায় জমা হবে। সব যোগ করে তিনি একজন বিশেষ পুলিস হতে পারেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল দৈনন্দিন কর্ম বা নিত্য কর্ম। প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ থেকে রাতে শয্যাগ্ৰহণ পর্যন্ত দৈনন্দিন রুটিন। আগে মানুষের গুণ ও কর্মদক্ষতা অনুযায়ী শাস্ত্রনির্দিষ্ট রুটিন ছিল। সেখান থেকে জন্ম নিত সামাজিক সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতি অবলম্বন করেই ভারতবর্ষের সামগ্রিক উত্থান ঘটেছিল। সাহিত্যে, শিল্পকলায়, দর্শন ও সত্যান্বেষণে, নন্দনতত্ত্বে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্বে, শস্ত্রবিদ্যায়, চিকিৎসাবিদ্যায় ও আরও অন্যান্য চর্চায় যা আজও বিস্ময় জাগায়। সেই জ্ঞানভাণ্ডার থেকে আহরণ বা হরণ করে আজও গবেষণা চলছে, নিত্য নতুন পথের দিশা পাওয়া যাচ্ছেযে সংস্কার থেকে সেই জ্ঞানভাণ্ডার সৃষ্টি হয়েছিল তা হল ঋষি-সংস্কার ঋষিদের দৈনন্দিন জীবন ও কর্ম থেকে তৈরী হয়েছিল ঋষি-সংস্কার আর তা থেকে পাওয়া গেল ঋষি-সংস্কৃতি। কায়মনোবাক্যে পবিত্রতা রক্ষা, নির্লোভ জীবনযাপন, ত্যাগ, কঠোর তপস্যা ইত্যাদির ফল এই ঋষি-সংস্কৃতি যা বিবিধ বিদ্যার জন্ম দিয়েছে। ঋষি অর্থাৎ ক্রান্তদর্শী, যিনি পরম সত্যের দ্রষ্টা। সেই ঋষি প্রদর্শিত পথ ছিল সত্যের পথ, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের (পুরুষার্থ) পথ।

আজ যে সংস্কৃতিতে পৃথিবী চালিত তা কেবল অর্থ ও কাম সম্বলিত, তাই সার্বিক উন্নতি অধরা। যে দেশ অর্থ ও কামে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে সে দেশে দেখা যাচ্ছে মানসিক অবসাদ ও আত্মহত্যাও বেশি। একে তো সার্বিক উন্নতি বলা যায় না। ধর্ম(righteousness) ও মোক্ষ বাদ দিয়ে কেবল অর্থ ও কাম চরিতার্থ করে সার্বিক দীর্ঘমেয়াদী উন্নতি হয় না। এই সঠিক উন্নতির পথ ভারতবর্ষই দেখিয়েছিল, নিজে তা অনুসরণ করে সার্বিক, দীর্ঘমেয়াদী (sustainable) উন্নতি ঘটিয়েছিল। আজ GDP গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ০-১০০০ সাল পর্যন্ত ভারতের GDP ছিল বিশ্ব GDPর শতকরা ৩২-২৯ ভাগ। বিশ্বে ভারত তখন প্রথম স্থানাধিকারী, দ্বিতীয় স্থানাধিকারী ছিল চীন। ১২০০ সালের পরে ভারতের বিভিন্ন অংশে সাংস্কৃতিক অধঃপতন ঘটে। ফলে ১৫০০-১৬০০ সালে GDP কমে হয় ২৪.৫%, আবার ১৭০০ সালে একটু বেড়ে হয় ২৫%, তখনও বিশ্বে প্রথম স্থানে ভারত। বৃটিশ আমলে GDP ঝড়ের বেগে নামতে থাকে, নামতে নামতে শেষ পর্যন্ত ৪.২%তে পৌঁছয়। এটা কি নবজাগরণ?

আমাদের সাংস্কৃতিক অধঃপতন তথা সার্বিক অধঃপতনকে পরাধীন ভারতের তথাকথিত নবজাগরণ (রেণেশাঁ) রোধ করতে পারে নি। শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ ও আরও অন্যান্য মহাত্মারা না এলে, সংস্কৃতির সঠিক দিশা না দেখালে অবস্থা আরও ভয়ংকর হত। অথচ পরবর্তীকালে তাঁদের আমরা পাত্তাই দিই নি। আমরা তখন পাশ্চাত্যের ভোগবাদী (অর্থ ও কাম) সংস্কৃতিতে কিংবা শিকড়হীন উদ্ভট বিপ্লবের সংস্কৃতি নিয়ে লাফালাফি করছি। তাই স্বাধীনতা উত্তর ভারতে এই অধঃপতন আরও ত্বরাণ্বিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে সার্বিক দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে সংস্কৃতির ভূমিকাই প্রধানতম। বাকি সবকিছু এর মধ্যেই নিহিত। আদর্শ দৈনন্দিন জীবনযাপন ছাড়া, চিন্তা ও কর্মের উপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এই সংস্কৃতি আসতে পারে না। তাই এক্ষেত্রে ‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও’ বললে চলবে না।