‘স্বাধীনতা’ কারে কয়?

‘স্বাধীনতা’ কারে কয়?

—শ্রিয়ংকর আচার্য

স্বাধীনতা = স্ব + অধীনতা৷ ‘স্ব’ কাকে বলে তাই জানি না, তার আবার অধীনতা? যদি বলি ‘আমি স্বাধীন’, তার অর্থ কী হয়,—আমি ‘স্ব’এর অধীন৷ ‘স্ব’ অর্থে আবার ‘আমি’৷ তাহলে দাঁড়াচ্ছে আমি আমার অধীন৷ এখানে দুজন ‘আমি’ চলে আসছে—একজন প্রভু, অন্যজন তার অধীন বা ভৃত্য৷ ‘আমি স্বাধীন’— আমি স্ব-এর অধীন৷ আমি, অর্থাৎ ভৃত্য-আমি প্রভু-আমির(স্ব-এর) অধীন৷ শেষ পর্যন্ত সেই অধীনই হলাম৷ তবে হ্যাঁ, যেহেতু অন্য কারুর অধীন নই, তাই বলছি ‘আমি স্বাধীন’৷

অন্য কারুর অধীন না হলেও আমি ‘অধীন’, ঐ স্ব বা প্রভু-আমি’র অধীন৷ অন্য কারুর অধীনতা স্বীকার না করে যদি কেবল ঐ প্রভু-আমি’র অধীনতা স্বীকার করি এবং সেইমত চলি তবেই নিজেকে ‘স্বাধীন’ বলতে পারি৷

ব্যবহারিক ক্ষেত্রে মানুষ যতই দাবি করুক সে স্বাধীন, আসলে সে স্বাধীন নয়, সবসময়ই অন্যের অধীন৷ চাকুরীজীবী একভাবে অন্যের অধীন, বিবাহিত আর একধরণের অধীন, আরও নানাবিধ সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে আমরা নানাধরণের অধীনতা স্বীকার করে বাঁচি৷

আসলে অন্য মানুষের অধীন হওয়ার যে অধীনতা তা গৌণ৷ এই গৌণ অধীনতা আর এক মুখ্য অধীনতা থেকে আসে, তা হল প্রাকৃতিক তিন গুণ৷ যেহেতু আমরা প্রকৃতিজাত, তাই জন্মসূত্রেই আমরা সকলেই সেই প্রাকৃতিক গুণের অধীন৷ প্রাকৃতিক গুণ গুলি হল—সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ৷ এগুলির অধীনেই আমরা রয়েছি৷ এগুলিই ঘাড় ধরে আমাদের কর্ম করায়, আমরা ভাবি আমরা স্বাধীনভাবে করছি৷

প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ৷

অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে॥গীতা৷৩/২৭॥

সব কর্মই প্রাকৃতিক গুণ দ্বারা কৃত, অহঙ্কারে মোহিত মানুষ মনে করে, ‘আমি কর্তা’৷

ষড়রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য), অষ্টপাশ (লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, কুল, শীল, মান , সঙ্কোচ, জুগুপ্সা) যা যা আমাদের বন্ধন বা বন্ধনের কারণ, সবই ঐ ত্রিগুণের অধীন৷

বিড়ি খাওয়া, চুমু খাওয়া বা খাদ্যাখাদ্যের স্বাধীনতা নিয়ে যতই লড়াই করি না কেন তার পিছনেও রয়েছে ওই প্রাকৃতিক গুণের প্রভুত্ব৷ ভাবছি এটা আমার স্বাধীনতা, আসলে সেই গুণেরই অধীনতা৷

আমাদের সবরকম বাহ্যিক অধীনতার মূলে রয়েছে ঐ তিন গুণের খেলা৷ একটি উদাহরণ নেওয়া যাক৷ লোভ একটি রজোগুণ৷ এই লোভের অধীন হয়ে লোভ চরিতার্থ করার জন্য ছুটলাম লোকাল কমিটিতে দাদা ধরতে৷ দাদার সাহায্যে লোভ চরিতার্থ হল বটে, তবে সেই দিন থেকে আমি দাদার অধীন হয়ে গেলাম৷ এভাবেই আমরা নানা ধান্দায়, নানাভাবে অধীনতা বাড়িয়েই চলেছি৷ শাস্ত্র তাই অপরিগ্রহের উপদেশ দেয়৷ লোভপূর্বক পরিগ্রহ বা দান (favour)নিলেই অধীনতাবোধ আসে৷

স্বাধীনতা মানে বাহ্যিক অধীনতা তথা ত্রিগুণাত্মিকা অধীনতার অবসান এবং নিজের অধীনতায় অর্থাৎ সেই প্রভু-আমি বা চৈতন্য-আমি’র অধীনতায় ফিরে আসা৷ ‘মন চল নিজ নিকেতনে৷’এই যাত্রাপথে তমোগুণ রজোগুণের হাতছানি অতিক্রম করে সত্ত্বগুণের অধীন হতে হবে৷ তখন জ্ঞান (পরাবিদ্যা) ও আনন্দ (সুখ নয়, রসাস্বাদন) ছাড়া আর কোন কিছুতেই আকর্ষণ থাকবে না৷ এ এক নৈতিক, আনন্দময় অবস্থান, যেখানে কেবল সদ্গুণের সমারোহ৷ স্বাধীনতা তখন ‘সু’-এর অধীনতা৷ স্বাধীনতার আস্বাদন এখান থেকেই শুরু৷ তারপর সেই ‘সু’-এর অধীনতা অর্থাৎ সত্ত্বগুণের অধীনতাকেও অতিক্রম করে গুণাতীত হলে তবেই পরিপূর্ণ স্বাধীনতা৷ তখন আর গুণের অধীন নই, এমন কি সত্ত্বগুণেরও নয়, কেবল স্ব-এর অধীন৷

কে এই ‘স্ব’ বা প্রভু-আমি? শাস্ত্র বলছে ‘পরমাত্মা’৷ আর কে এই ভৃত্য-আমি যে কেবল গুণাধীন মোহগ্রস্ত হয়ে খাবি খেয়ে মরে? — শাস্ত্র বলছে ‘জীব’ বা ‘জীবাত্মা’৷

দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।

তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্যনশ্নন্নন্যোহভিচাকশীতি॥

সুদৃশ্য পাখার দুই পাখি বন্ধুর মতো সংযুক্ত হয়ে একই গাছে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের একজন গাছের ফলকে স্বাদের জন্য খায় আর অন্যজন ফল না খেয়ে সব দিক দেখতে থাকে।

গাছটি শরীরের প্রতীক৷ যে পাখিটি ফল খায়, সে কর্মফল ভোগ করে, সে গুণাধীন অর্থাৎ জীবাত্মা, আর যে ফল খায় না কেবল সাক্ষীস্বরূপ, সে গুণাতীত অর্থাৎ পরমাত্মা৷

জীবাত্মার চেতনা (ভৃত্য-আমি) যখন চৈতন্যে (প্রভু-আমি) লয়প্রাপ্ত হয় তখনই আসে সেই চির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা৷ ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী৷’ তবে অত বড় স্বাধীনতা যদি না-ও পাই, অন্ততঃ ‘সু’-এর অধীন তো থাকতে পারি৷ ‘সু’-এর অধীনে (সত্ত্বগুণে) আসার পর ‘স্ব’-এর অধীনে আসা৷

‘এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাবো’, কি বলেন?

লেখক—শ্রিয়ংকর আচার্য