Intellectual কারে কয়?

Intellectual কারে কয়?

শ্রিয়ংকর আচার্য

শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে আছে৷ একজন তার বন্ধুকে এসে বললে, “ওহে, কাল ও-পাড়া দিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় দেখলাম, সে-বাড়িটা হুড়মুড় করে পড়ে গেল৷” বন্ধু বললে, “দাঁড়াও হে, একবার খবরের কাগজখানা দেখি৷” এখন বাড়ি হুড়মুড় করে পড়ার কথা খবরের কাগজে কিছুই নাই৷ তখন সে ব্যক্তি বললে, “কই খবরের কাগজে তো কিছুই নাই৷—ও সব কাজের কথা নয়৷” সে লোকটা বললে, “আমি যে দেখে এলাম৷” ও বললে, “তা হোক, যেকালে খবরের কাগজে নাই, সেকালে ও-কথা বিশ্বাস করলুম না৷” ঐ খবরের কাগজ নির্ভর লোকটি খাঁটি intellectual. কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, “আজ কী খেলেন?” বলবেন, “দেখি তো, ইউরোপীয় পণ্ডিতরা এ বিষয়ে কী বলেছেন৷” পুঁথিগত বিদ্যায় অগাধ আস্থা৷ নিজের বোধ বুদ্ধি পুস্তকে বিসর্জন দিয়ে বসে আছেন৷

Intellectual তৈরীতে মূলতঃ একটা factorই কাজ করে, তা হল রসবোধে৷ ধরা যাক, x ও y দুজনেই বই পড়ে শিক্ষিত৷ বেশ ভালোরকম শিক্ষিত৷ এদের মধ্যে রসবোধে যার যত ঘাটতি থাকবে তার তত বড় intellectual হবার সম্ভাবনা৷ সে কাগজে শিল্প সমালোচনা, রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি বিষয়ে article লিখবে, যা পরের দিনই লোকে ভুলে যাবে, বাস্তবে কোন কাজে আসবে না৷ তবে কিছু না বুঝেই, তাঁর ডিগ্রী দেখে, কিংবা উচ্চপদ দেখে লোকে তাঁকে বিদগ্ধ বলবে, তাঁর লেখা নিয়ে ঠাট্টা করার সাহস পাবে না৷ সবারই তো মগজ ধোলাই হয়ে আছে৷ বিদেশের স্বীকৃতি/পুরস্কার থাকলে তো আর কথাই নেই৷ সভা সমিতিতে এমন বক্তৃতা দেবে যার কোন মাথামুণ্ডু থাকবে না৷ যে বিষয় নিয়ে লিখবে বা বলবে তার গোড়ায় জল না দিয়ে ডগায় কিংবা ডালপালায় জল দেবে৷ সব কিছু কেটে কেটে দেখবে, আংশিক ব্যাখ্যা দেবে যা কখনো সমগ্রকে ধরতে পারবে না৷

আসলে রসবোধ না থাকলে কোনকিছুরই মর্মে পৌঁছনো যায় না৷ রসবোধই সত্যবোধ৷ পরম সত্য(ব্রহ্ম)স্বয়ং রসস্বরূপ৷ রসো বৈ সঃ৷

শিল্পের ক্ষেত্রে রসবোধ শব্দটি প্রযুক্ত হয়৷ শিল্পের উদ্দেশ্য ভাবকে রসে রূপান্তরিত করা৷ সেই রস আস্বাদন করে রসিক আনন্দ পায়, অরসিক (intellectual) পায় না৷ বর্তমান neuro-aesthetics এর গবেষণা বলে, দর্শকের মস্তিষ্কের কিছু বিশেষ network junction (default mode network) শিল্পের রসাস্বাদনে উদ্দীপ্ত হয় যা আনন্দের সূচক৷ একসঙ্গে অনেককে একই শিল্পকর্ম দেখিয়ে brain mapping করে দেখা যায় দর্শকের মস্তিষ্কের ঐ networkএর মধ্যে উদ্দীপনের বিশেষ তারতম্য আছে৷ একই শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্বেও উদ্দীপনের এই তারতম্যকে বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে না৷ ভারতীয় রসতত্ত্ব বলে রসবোধের তারতম্য৷ কে রসিক? —যার অন্তরে রয়েছে “মালিন্যহীন স্বতঃলব্ধ প্রজ্ঞা”৷ মনে রাখতে হবে এটা স্বতঃলব্ধ৷ পুস্তক বা ডিগ্রীলব্ধ নয়৷

তাহলে অরসিক শিল্পে কী পায়?

অরসিক তথা intellectual শিল্পে বিষয় (content) খোঁজে, ব্যাকরণ খোঁজে, কারিগরী দক্ষতা খোঁজে৷ রসের নাগাল পায় না, তাই ওইসব parameter দিয়েই শিল্প বিচার করে৷ বড় বড় article লেখে, যা মানুষের স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধিকে বিভ্রান্ত করে, ভুল পথে চালিত করে৷

Intellectualরা যে অরসিক, রবীন্দ্রনাথ একথা বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর ব্যঙ্গকৌতুক ‘অরসিকের স্বর্গপ্রাপ্তি’তে৷ Intellectual গোকুলনাথ দত্ত স্বর্গে এসে কোনকিছুরই মানে খুঁজে পাচ্ছে না৷ সেখানকার সংস্কৃতি দপ্তরের অধিকারী ভরত মুনির সঙ্গে সঙ্গীত আলোচনা করছে৷ আর সকলে যখন শ্রীমতী রম্ভার গানের রসাস্বাদনে মুগ্ধ, গোকুলনাথ তখন গানের নিয়ম, technology নিয়ে চিন্তিত৷ তার কাছে ভাল লাগাটা কোন ব্যাপার নয়, নিয়মটাই ব্যাপার৷

ভরতঠাকুরকে intellectual গোকুলনাথ বলছে, “আচ্ছা, অধিকারীমশায়, শুনেছি গান-বাজনায় আপনি ওস্তাদ, একটি প্রশ্ন আপনার কাছে আছে। গানের সম্বন্ধে যে ক’টি প্রধান অঙ্গ আছে, অর্থাৎ সপ্ত সুর, তিন গ্রাম, একুশ মূর্ছনা— কী বললেন? আপনারা এ-সমস্ত মানেন না? আপনারা কেবল আনন্দটুকু জানেন! তাই তো দেখছি— এবং যত দেখছি তত অবাক হয়ে যাচ্ছি। (কিয়ৎক্ষণ শুনিয়া) ভরতঠাকুর, ঐ-যে ভদ্রমহিলাটি— কী ওঁর নাম— রম্ভা? উপাধি কী বলুন। উপাধি বুঝছেন না? এই যেমন রম্ভা চাটুজ্জে কি রম্ভা ভট্টাচার্য, কিংবা ক্ষত্রিয় যদি হন তো রম্ভা সিংহ—এখানে আপনাদের ও-সব কিছু নেই বুঝি? আচ্ছা, বেশ কথা, তা, শ্রীমতী রম্ভা যে গানটি গাইলেন আপনারা তো তার যথেষ্ট প্রশংসা করলেন; কিন্তু ওর রাগিণীটি আমাকে অনুগ্রহ করে বলে দেবেন? একবার তো দেখছি ধৈবত লাগছে, আবার দেখি কোমল ধৈবতও লাগে, আবার গোড়ার দিকে— ওঃ, বুঝেছি, আপনাদের কেবল ভালোই লাগে, কিন্তু ভালো লাগবার কোনো নিয়ম নেই। আমাদের ঠিক তার উলটো, ভালো না লাগতে পারে, কিন্তু নিয়মটা থাকবেই৷”

যার রসবোধ নেই সে নিয়ম ছাড়া আর কী দেখবে?

এদেশে বৃটিশ আমলে কেরাণী তৈরীর উদ্দেশ্যে যে শিকড়হীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল এই intellectual শ্রেণী সেই শিক্ষার ফসল৷ সেই শিক্ষা আমাদের অতিমাত্রায় পাশ্চাত্যের পুস্তক অভিমুখী

করেছিল, তাদের incomplete নাবালক তত্ত্বগুলোর প্রতি অতিমাত্রায় শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাশীল করে তুলেছিল৷ এখনো তাই৷ কোন Incomplete তত্ত্বকে(ism) কেউ complete ভেবে তাতে body ফেলে দিলে সে মৌলবাদী হবেই৷ Intellectualদের মধ্যে এই মৌলবাদী ভাব লক্ষ্য করা যায়৷

Intellectualরা ঘোরতর ঈশ্বরবিরোধী৷ ঈশ্বরে বিশ্বাসটা তাদের কাছে মৌলবাদিতা৷ ঈশ্বর কী, না জেনে ঈশ্বরবিরোধিতাটা তাদের কাছে মৌলবাদিতা নয়৷ কেউ যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে সে আর এ জীবনে intellectual হতে পারবে না৷ শুধু তাই নয় intellectualরা তাকে একঘরে করে দেবে, নানারকম stamp দিয়ে অস্পৃশ্য করে দেবে৷ বিদ্বজ্জন মহলে তার মতামতের কোন দামই থাকবে না৷ নাস্তিক না হলে দলে নেবে না৷ এটা একটা মোটামুটিভাবে আবশ্যিক শর্ত৷

আজকাল আর এক ধরণের নব্য intellectual দেখা যাচ্ছে যারা কোন ismএ body ফেলতে রাজী নয়৷ তারা ভাসমান থাকতে পছন্দ করে৷ যার thought নির্দিষ্ট হয় নি তার actionও নির্দিষ্ট নয়৷ কী করতে হবে, কোন্ পথে যেতে হবে সে সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই৷ এদিকে অনেক বই পড়ে ফেলেছে৷ মাথায় ‘হিং টিং ছট্ এর কাণ্ড কারখানা৷ তাই সকলের ছিদ্রান্বেষণই তাদের প্রধান কাজ৷ কোনও সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গী না থাকাতে তারা confused এবং inconsistent. তাদের depressionএর ওযুধ খেতে হয়৷ নিজেই সমাজের বোঝা হয়ে যায়৷

সংস্কৃত শিক্ষার অবসানের ফলে ভারতীয় তত্ত্বের চর্চা বন্ধ হয়ে যায়৷ ভারতীয় তত্ত্ব আর পাশ্চাত্যের তত্ত্ব পাশাপাশি পড়লে এই উদ্ভট শিক্ষিত সমাজ তৈরী হত না৷ তখন এক উদার শিক্ষিত সমাজ তৈরী হত৷ কেন না, সত্যদ্রষ্টা ঋষি প্রণীত অনেক তত্ত্বই complete ও unified. কিন্তু কে তার খবর রাখে? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তার ছিটেফোঁটাও নেই৷

Intellectualদের সুচিন্তিত মতামত দেখলে বোঝা যায় তাঁরা দেশের কত বড় সম্পদ৷ এই সম্পদ যত বাড়ে দেশ তত পিছিয়ে যায়৷ যে কোন দেশের ক্ষেত্রেই মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে৷

লেখক—শ্রিয়ংকর আচার্য