আধ্যাত্মিকতা: খায়, না মাথায় দেয়?

আধ্যাত্মিকতা: খায়, না মাথায় দেয়?

লক ডাউনে ঘরে বসে আছি৷ বাইরে অঝোরে বৃষ্টি৷ বাগানের আম, নিম, জবা, রঙ্গন আর কাঁঠাল গাছ মহানন্দে ভিজছে, ডালপালা নেড়ে খুব ফূর্তি করছে৷ আকাশভরা মেঘ৷ দেখতে দেখতে মনে হল, এই ঘরবন্দী আমি, ঐ গাছপালা, আকাশ, রাস্তার ঐ কাকভেজা অচেনা লোক, মেঘ, বৃষ্টি—এসবের মধ্যে কি কোন সম্পর্ক আছে? নাকি সবই খণ্ড, বিচ্ছিন্ন? যদি সম্পর্ক কিছু থেকে থাকে তবে কী সেই সম্পর্ক? সেই সম্পর্কের প্রমাণ কি? তা কি অনুভব করা যায়? অনুভবের ফলাফলই বা কি? প্রশ্নগুলোর উত্তর চিন্তা করতে লাগলাম৷ আধ্যাত্মিকতার শরণাপন্ন হলাম৷

আধ্যাত্মিকতা হল এক কথায় মহাবিশ্বে এক সামগ্রিক সম্পর্ক স্থাপনের তত্ত্ব৷

মহাবিশ্বের যে কোন দুই সত্তা যদি কোন সম্পর্কে আবদ্ধ হয় তা কখনোই লৌকিক অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতে পারে না, হতে পারে এক ইন্দ্রিয়াতীত সম্পর্ক৷ কিন্তু ইন্দ্রিয়াতীত সম্পর্কের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ প্রমাণ সম্ভব নয়৷ তাহলে এই সম্পর্কের, অর্থাৎ আধ্যাত্মিক সম্পর্কের অস্তিত্বের প্রমাণ কোথায়? বলা যায়, তার প্রমাণ রয়েছে আধ্যাত্মিক ব্যক্তির উপলব্ধিতে৷ সেই উপলব্ধি প্রতিফলিত হয় তাঁর নৈতিক আচরণে, পবিত্র চরিত্রগুণে, নিষ্কাম কর্মে আর সর্বোপরি মহৎ নিঃস্বার্থ, নিঃশর্ত প্রেমে৷ উপযুক্ত সাধনায় যে কেউ তাঁদের পথ অনুশরণ করে দেখতে পারে, আধ্যাত্মিকতা লাভ করতে পারে, অর্থাৎ এই বিশ্বজনীন সম্পর্কের উপলব্ধিতে উপনীত হতে পারে৷

আধ্যাত্মিক ব্যক্তি দেখেন ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্ ‘৷ এই বিশ্বের সবই তাঁর আপন৷ তাঁর কাছে এই সম্পর্ক এক অনন্ত প্রেমের, এক অনন্ত প্রীতির সম্পর্ক৷

বিষয়টিকে আমরা স্বার্থ ও পরার্থ দিয়ে ভাবতে পারি৷ যদি আমি কিছু চকোলেট পাই তখন আমি ঠিক করে নিই কাকে কাকে দেব৷ আমার একটা প্রীতিভাজন মানুষের set আছে, সেই setএর যারা সদস্য, তাদের সুখে সুখ পাই আবার তাদের দুঃখে দুঃখ পাই৷ চকোলেটগুলো তাদের মধ্যে বিতরণ না করে আমার তৃপ্তি হবে না৷ একা সবগুলো খাওয়ার সুযোগ থাকলেও আমি তা পারব না৷ কারণ আমি’র পরিসরটা (set) যে ‘আমি’ ছাড়িয়ে একটু বেড়ে গেছে৷ ঐ প্রীতিভাজনরা যে আমি’র পরিসরের মধ্যে ঢুকে বসে আছে৷ এই আমি’র পরিসরটাই স্বার্থের পরিসর৷ আর এই পরিসরের বাইরে রয়েছে পরার্থের পরিসর, যাদের নিয়ে আমি ভাবছি না৷ স্বভাবতঃই তাদের চকোলেট দিচ্ছি না৷ এই পরার্থকে স্বার্থের অন্তর্ভুক্ত করাই আধ্যাত্মিক সাধনার উদ্দেশ্য৷ তখন স্বার্থ আর পরার্থ এক হয়ে সবটাই মহাস্বার্থ হয়ে যায়৷ ধরা যাক, set A = স্বার্থ, B = পরার্থ, মহাজাগতিক set U = A + B (union). আধ্যাত্মিকতা এসে A = U করে দেয়৷ সবটাই স্বার্থ, পরার্থ বলে কিছু নেই৷ পর তো আপন হয়ে গেছে৷ পর বলে আর তো কিছু নেই৷

আমাদের মা, শ্রীশ্রীমা সারদা বলছেন, “…জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ৷ কেউ পর নয় মা, জগৎ তোমার৷” সে কি কথার কথা! নিজের জীবন দিয়ে তা কি দেখিয়ে দিয়ে যান নি? স্বামিজী আমেরিকায় গিয়ে নরম তুলতুলে বিছানায় ঘুমোতে পারছেন না! দেশের মানুষের দুর্দশার কথা ভেবে কাঁদছেন! ঐ শীতে ভূমি শয্যায় শয়ন করছেন৷ কেন?—তাঁর যে স্বার্থ পরার্থের ভেদ ঘুচে গেছে৷ সবার কষ্ট তিনি নিজের মধ্যে নিয়েছেন৷

‘আধ্যাত্মিকতা’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দেখা যাক৷ এতক্ষণ যা বলা হল তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা দেখে নিই৷ আধ্যাত্মিক্ = অধ্যাত্ম + ষ্ণিক্ ৷ ‘অধ্যাত্ম’ অর্থে আত্মাকে অধিকার ক’রে৷ তাহলে ‘আধ্যাত্মিক’ শব্দের অর্থ আত্মাকে অধিকার করে জাত৷ ‘আধ্যাত্মিকতা’র অর্থ আত্মাকে অধিকার করে জাত যে তত্ত্ব৷

সমস্ত জীবাত্মা (জীব) যখন একই সূত্রে সম্পর্কিত হয়ে যায় তখন পৃথক পৃথক জীবাত্মা বলে আর কিছু থাকে না৷ সবাই তখন শুদ্ধ, বুদ্ধ, নিত্য, মুক্ত পরমাত্মায় একাত্ম হয়ে যায়৷ জীবাত্মারূপ ঘট ভেঙে ঘটের জল পরমাত্মারূপ সাগরের জলের সঙ্গে মিশে এক হয়ে যায়৷ সাধকের তখন খণ্ডবোধ থেকে অখণ্ডবোধে উত্তরণ ঘটে৷ এই অখণ্ডতার বোধ, বিশ্বপ্রীতিবোধ মানুষকে জগতের কল্যাণ কর্মে নিয়োজিত করে এবং একই সঙ্গে মুক্তির কারণ হয়৷ ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’৷ এই অখণ্ডবোধই প্রেম৷ স্বামিজীর ভাষায় ‘প্রেম প্রেম, এইমাত্র ধন’৷ সকলের মধ্যেই এই প্রেম রয়েছে জাগরণের বিভিন্ন মাত্রায়, পরিপূর্ণ জাগরণের অপেক্ষায়৷ স্বামিজী বলছেন,

“জীব ব্রহ্ম মানব ঈশ্বর ভূত প্রেত আদি দেবগণ৷

পশুপক্ষী কীট অনুকীট এই প্রেম হৃদয়ে সবার৷”

এই প্রেমই স্বার্থ ও পরার্থের দ্বন্দ্ব মেটায়৷ তাই বলছেন, “ছাড় বিদ্যা, জপ, যজ্ঞ, বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল”৷

এবার উপনিষদ কি বলছে দেখি৷ বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীকে বলছেন, “ন বা অরে পত্যুঃ কামায় পতিঃ প্রিয়ো ভবতি আত্মনস্তু কামায় পতিঃ প্রিয়ো ভবতি৷ ন বা অরে জায়ায়ৈ কামায় জায়া প্রিয়া ভবতি আত্মনস্তু কামায় জায়া প্রিয়া ভবতি৷ ন বা অরে পুত্রাণাং কামায় পুত্রাঃ প্রিয়া ভবন্তি, আত্মনস্তু কামায় পুত্রাঃ প্রিয়া ভবন্তি৷”

অর্থাৎ, জায়ার নিকট যে পতি প্রিয় হয় তা পতির কারণে নয়, মায়ের নিকট যে পুত্র প্রিয় হয় তা পুত্রের কারণে নয়৷ তিনি বলছেন, তারা প্রিয় হয় তার কারণ সকলকে ব্যাপ্ত করে একই আত্মা বর্তমান আছে বলে৷ এখানে ‘আত্মনঃ’ অর্থে ‘নিজের’ নয়, ব্রহ্মের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্রহ্মকেই নির্দেশ করে৷ পরের উক্তিতে তা স্পষ্ট হয়—”ইদং সর্বং যদয়মাত্মা”, অর্থাৎ এই সবকিছু জড়িয়ে যিনি আছেন তিনি আত্মা৷

এই প্রসঙ্গে ঈশোপনিষদের কথা৷—”ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ৷ তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্ ৷৷” এর সরলার্থ হল, যেহেতু সকলেই অখণ্ড ঈশ্বরের অঙ্গীভূত সেহেতু সকলেই পরস্পরের একান্ত আপনজন৷ তা যদি হয়, স্বার্থপরের মতো একাকী কোন ভোগ্যবস্তু ভোগ করতে নেই, ভাগ করে ভোগ করতে হয়৷ একই কারণে কারও সম্পদ অপহরণ করার অর্থ হয় না৷ আপনার মানুষের সম্পদ কি কেউ অপহরণ করে নাকি? সোজা কথায় অখণ্ডজ্ঞান থেকে প্রীতির সঞ্চার, তা থেকে পরার্থপরতার উদ্রেক৷ এই স্বার্থ পরার্থের বিভেদ মুছে রবীন্দ্রনাথের সুরে বলা—”বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো৷ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো৷” তখন আধ্যাত্মিক দ্রষ্টা বিশ্বকে নিজের মধ্যে নিজেকে বিশ্বের মধ্যে অনুস্যূত দেখে৷


লেখকঃ শ্রিয়ংকর আচার্য