ধর্ম: খায়, না মাথায় দেয়?
ধর্ম: খায়, না মাথায় দেয়?
শ্রিয়ঙ্কর আচার্য
ধর্ম নিয়ে এখন সবার মাথাব্যথা৷ ধরা যাক, দু’দলের মধ্যে বিতর্ক হচ্ছে৷ একদল ধর্মের পক্ষে আর একদল বিপক্ষে৷ বিতর্ক ক্রমশ বিতণ্ডায় পরিণত হচ্ছে, গালাগাল চলছে, এরপর শুরু হবে মারামারি৷ এসব ক্ষেত্রে আপনি যদি দুই পক্ষকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা তো অনেকক্ষণ ‘ধর্ম’ নিয়ে অনেক বিতর্ক ইত্যাদি করলেন, নিশ্চয় ধর্মের একটা অর্থ বা সংজ্ঞায় আপনারা বিশ্বাস করেন এবং সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকে তর্কাতর্কি করেছেন, সেই সংজ্ঞাটা কি? এ প্রশ্নে অনেকেই সংজ্ঞা হারাবেন, কেন না, ধর্মের সংজ্ঞা ছাড়া ধর্মের আর সবকিছু তাঁরা জানেন৷ আর যাঁরা সংজ্ঞা হারাবেন না তাঁরা পাকাপোক্ত (precise) সংজ্ঞা দিতে পারবেন না তবে মোটামুটি একটা কিছু বলবেন যা হয়তো প্রকৃত সংজ্ঞার বিপরীত হবে৷ আরও মজার হবে যখন দেখবেন দু’পক্ষ ধর্ম সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পোষণ করেন এবং সেই ভিন্ন ভিন্ন ধারণা মাথায় রেখেই এতক্ষণ অকারণ কুস্তি করে গেলেন৷ যদি একটি শব্দের নির্দিষ্ট কোন অর্থ বা সংজ্ঞা না জানা থাকে তবে তাই নিয়ে, তার উপকারিতা অপকারিতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা বা তর্ক অর্থহীন হয়ে যায়৷ একটি শব্দ একটি নির্দিষ্ট অর্থ বা তাৎপর্য নিয়েই সৃষ্ট হয়, সেটি জানতে হয়, তারপর তর্ক শুরু করতে হয়, এটুকু না মানলে পুরো শিক্ষাটাই হরিদাস পাল হয়ে যায়, জ্ঞান-অজ্ঞান-অপজ্ঞান তফাৎ করা যায় না৷
‘ধর্ম’ বলতে কি বোঝায় তা নিহিত রয়েছে ‘ধর্ম’ শব্দটির মধ্যেই, বাইরে থেকে অর্থ আমদানি করার দরকার হয় না৷ ধৃ + মন্ = ধর্ম৷ ধৃ—অর্থে ধারণ করা, অর্থাৎ যা ধারণ করে তা—ই ধর্ম৷ কে ধারণ করে? — কতকগুলি বৈশিষ্ট্য, গুণ বা ধর্ম৷ ব্যাপারটা কিরকম? আমরা পদার্থবিজ্ঞানে পড়ি ‘পদার্থের ধর্ম’ যাকে বলে properties of matter. এখানে ‘ধর্ম’ শব্দটি কি অর্থে ব্যবহৃত? পদার্থের ধর্ম বলতে পদার্থের নিজস্ব গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে বোঝায়৷ ‘স্বভাব’ও বলা যেতে পারে, যে স্বভাব পদার্থকে চিহ্নিত করে, তাকে বিশিষ্ট করে৷ স্কুলপাঠ্য বইতে তিন রকম পদার্থের কথা বলা হয়: কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়৷ এগুলোর প্রত্যেকের ধরণ-ধারণ বা গুণাবলী আলাদ৷ এই গুণাবলী বা ধর্মাবলী প্রকৃতি দ্বারা সুনির্দিষ্ট এবং এগুলো দিয়েই কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়কে চেনা যায়, তাদের পৃথক করা যায়৷ (যেমন হেড অফিসের বড়বাবুকে তাঁর গোঁফ দিয়ে চেনা যায়)৷ তাই এগুলো স্বভাব বা ধর্ম যা তাদেরকে ধারণ করে বা ধরে রেখেছে৷ এই ধর্ম বা স্বভাব জড় পদার্থের ক্ষেত্রে একেবারে সুনির্দিষ্ট, জড়ের শক্তি নেই তার পরিবর্তন করে৷ কোন এক বসন্তের সকালে কঠিন পদার্থের ইচ্ছে হল নির্দিষ্ট আকার ত্যাগ করে তরলের মতো গড়িয়ে যাই, সে কি তা পারবে? পারবে না৷ তাই জড়ের ‘ধর্ম’ নিয়ে কোন বিতর্ক বা বিবাদ নেই, পরীক্ষাগারে যা প্রমাণিত হবে সেটাই মেনে নিতে হবে৷ জড়ের ধারক বা পরিচায়ক হবে সেই প্রমাণিত ধর্মগুলোই৷
কিন্তু যেই আমরা জড়ের সীমা ছাড়িয়ে জীবজগতে প্রবেশ করি তখন ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হয়ে যায়৷ জীবের ধর্ম বা স্বভাবের ক্ষেত্রে অত কড়াকড়ি নেই৷ জড়ের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নিয়ম যতটা দৃঢ়, জীবের ক্ষেত্রে ততটা নয়৷ জীবের ক্ষেত্রে নিয়মের শৈথিল্য রয়েছে, যেন জীবকে কিছু স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে৷ উদাহরণস্বরূপ, এক বিশালকায় পাথরখণ্ড ও একটি ক্ষুদ্র এককোষী এমিবার তুলনা করা যেতে পারে৷ এদেরকে যদি কলকাতায় রাখা হয় তবে পাথরখণ্ডটির তাপমাত্রা পরিপার্শ্বের সমান হবে, কারণ বিজ্ঞানের নিয়মানুযায়ী পাথরখণ্ডটি পরিপার্শ্বের সঙ্গে তাপীয় সাম্যে (Thermal equilibrium) আসবে৷ কিন্তু এমিবা তার দেহের তাপমাত্রা নিজেই বজায় রাখবে৷ অবার এই দুটিকে যদি দার্জিলিঙ নিয়ে যাই, সেখানে পাথরের তাপমাত্রা পরিপার্শ্বের সমান হবে, কিন্তু এমিবা তার দেহের তাপমাত্রা বজায় রাখবে, পরিপার্শ্বের সঙ্গে তাপীয় সাম্যে আসবে না৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে, জড়ের ধর্ম যেমন নির্দিষ্ট, জীবের ধর্ম সে অর্থে নির্দিষ্ট নয়৷ জীবের একটা Self বা ব্যক্তিত্ব আছে যা দিয়ে ধর্মের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে৷
জীবজগতের Evolution বা অভিব্যক্তির পথ ধরে আমরা যত এগোব ততই ধর্মের এই পরিবর্তনশীলতা, শৈথিল্য আরও বিচিত্র রূপ নেবে৷ পরিশেষে যখন আমরা মানব প্রজাতিতে পৌঁছব তখন ধর্মের মধ্যে কোন নির্দিষ্টতা খুঁজে পাব না৷ শৈথিল্য বা বৈচিত্র্য এতটাই হবে যে মানুষের মধ্যে বিপরীতমুখী ধর্ম বা স্বভাব দেখতে পাব৷ মানুষ সত্যি কথা বলতে পারে, আবার মিথ্যা কথাও বলতে পারে; ভালবাসতে পারে আবার ঘৃণাও করতে পারে; উপকার করতে পারে আবার অপকারও করতে পারে৷ এভাবে বিপরীতমুখী ধর্মগুলোকে আমরা পাশাপশি দুটো সারিতে (column) লিখে ফেলতে পারি৷ একটি সারিতে (column) যদি সদ্গুণগুলোকে (সত্যবাদিতা, ভালবাসা, উপকার করা ইত্যাদি) রাখি আর পাশের সারিতে (column) যদি অসদ্গুণগুলোকে রাখি তাহলে একটা প্রশ্ন হতে পারে, আমি মানুষের ধর্ম বলতে কোন্ সারিটিকে নির্দেশ করবো? সদ্গুণগুলোকে, নাকি অসদ্গুণগুলোকে, নাকি উভয়কেই?
এক্ষেত্রে আমাদের আপ্তবাক্য বা ঋষিবাক্য অবলম্বন করতে হবে, বিজ্ঞানে যাকে basic postulate বলে ধরা হয়৷ গোড়ায় এই ঋষিবাক্যকে basic postulate হিসেবে মেনে নিলে ধর্মবিষয়টি নিয়ে একটি সম্পূর্ণ একীভূত তত্ত্ব (complete and unified) নির্ণয় সম্ভব যা জীবনে আমরা উপলব্ধি করতে পারি৷ Basic postulateএ বিশ্বাস স্থাপন করেই বিজ্ঞানের ডালপালাও নির্মিত হয়৷ যেমন ইউক্লিডের basic postulateএর উপর দাঁড়িয়ে আছে classical geometry, নিউটনের basic postulateএর উপর নির্মিত হয়েছে classical mechanics. তেমনি quantum mechanics কিংবা electromagnetic theoryর পিছনেও রয়েছে কয়েকটি basic postulate, যা নিয়ে কোন প্রশ্ন করা চলে না৷ এগুলো মেনে নিয়েই যুক্তির ইমারত তথা mathematical model নির্মিত হয় যা পরীক্ষাগারে সমর্থিত হয়৷
ধর্মের ক্ষেত্রে অর্থাৎ মানুষের ধর্ম নির্ণয়ের ক্ষেত্রে basic postulate বলে, ওই সদ্গুণের সমষ্টিই মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য বা স্বভাব বা ধর্ম৷ মানুষ স্বভাবতঃই সদ্গুণসম্পন্ন৷ তাহলে সদ্গুণের বিপরীত অসদ্গুণগুলো কোত্থেকে এল? সেগুলো কি মানুষের স্বভাব নয়? Basic postulate বলে সেগুলো সংস্কার৷ সংস্কারের উৎপত্তি ও নিবাস মানুষের অবচেতন মনে৷ আমরা যখনই কোন চিন্তা বা কর্ম করি তা আমাদের অবচেতন মনে একটা ছাপ বা প্রবণতা রেখে যায়৷ জমা হতে থাকা এই সব প্রবণতা বা ছাপের সমষ্টি হল আমাদের সংস্কার৷ সেই সংস্কার আমাদের ঐ-জাতীয় আর একটি চিন্তা বা কর্মে উদ্বুদ্ধ করে৷ পরবর্তী চিন্তা বা কর্ম যা পূর্ববর্তী অসৎ চিন্তা বা অসৎ কর্মপ্রসূত সংস্কার দ্বারা অনুপ্রাণিত তা আবার ঐ জাতীয় অসৎ গুণাত্মক সংস্কার তৈরী করে৷ অসদ্গুণাত্মক সংস্কার এভাবে সদ্গুণাত্মক স্বভাব বা ধর্মের উপর আবরণ সৃষ্টি করে যা স্বভাব বা সদ্গুণকে প্রকাশিত হতে দেয় না৷ চিন্তা ও কর্মের ব্যাপারে তাই সচেতন হতে হয়৷ সৎ চিন্তা ও সৎ কর্ম সদ্গুণাত্মক সংস্কার তৈরী করে যা অসৎ চিন্তা ও অসৎ কর্ম প্রসূত অসদ্গুণাত্মক সংস্কারের আবরণ সরাতে হাতিয়ার হয় যাতে সহজাত সদ্গুণ বা স্বভাব প্রকাশিত হয়৷
এই সহজাত সদ্গুণসমষ্টি বা স্বভাবকে কার্যকর বা বিকশিত (manifest) করাই ধর্মের উদ্দেশ্য৷ তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, ধর্মকে (যা সহজাত) প্রকাশিত বা কার্যকরী করা বা ধর্মে (স্বভাবে) পৌঁছনোই ধর্মের উদ্দেশ্য৷ একটি ‘ধর্ম’ লক্ষ্য (goal) এবং অন্য ‘ধর্ম’টি উপায় (means). মানুষের এই সহজাত সদ্গুণাত্মক স্বভাবকেই স্বামিজী divinity বলেছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘each soul is potentially divine’. তারপর ধর্মের সংজ্ঞা দিচ্ছেন, ‘Religion is the manifestation of divinity already in man.’ Divinity বলতে তিনি সমস্ত সদ্গুণের সমষ্টি বলতে চেয়েছেন যা আমাদের স্বভাব৷ এই সদ্গুণাত্মক স্বভাব অসদ্গুণাত্মক সংস্কারের আবরণে আবৃত৷ সেই আবরণ সরানোকেই স্বামিজী manifestation বলতে চেয়েছেন৷ ধর্ম তাই অন্তর্নিহিত দেব-স্বভাবের প্রকাশ৷ যে কোন ধর্মের ক্ষেত্রেই এটা সত্য৷ প্রাতিষ্ঠানিকতা, রাজনীতি তাদের স্বার্থে এই সত্যকে বিকৃত করে৷
লেখক—শ্রিয়ংকর আচার্য